একাত্তরের উদ্দীপনা: যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের তিরস্কার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী একেএম মোজাম্মেল হকের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ আগামী অধিবেশনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে। গত মাসে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর পাকিস্তান সরকারিভাবে এ নিয়ে যে জবাব দেয় তার বিরুদ্ধে করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন ওই মন্ত্রী। ইসলামাবাদ বলেছে যে, তারা ফাঁসি কার্যকর করায় গভীরভাবে বিক্ষুব্ধ। তারা দাবি করে যে, ১৯৭১ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো গণহত্যার ঘটনা ঘটে নি।
এটা বলতেই হবে যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় বাঙালিরা ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় করে যা বলতে হয় তাহলো বাঙালি গেরিলা মুক্তিবাহিনী লুটেরা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, যারা ছিল তাদের থেকে বেশি অস্ত্রে সজ্জিত। স্বাধীনতার যোদ্ধারা দেখতে পায় যে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে, ৪৪তম এ দিবসটি সম্প্রতি উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশ। উপরন্তু, অতি উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। আড়াই লাখের বেশি নারীকে ধর্ষণ করেছে। তারা প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসররা বাংলাদেশি জনগণের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে, যা এখনও অব্যাহত আছে।
পরাজিত শক্তি হিসেবে পাকিস্তান কখনও এই নৃশংসতা স্বীকার করে নেয় নি। পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল সে বিষয় মানতেও তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তানে যারা ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে তারা যুক্তি দেখান যে, ১৯৭১ সালে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রাম হয় নি, হয়েছিল ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধমাত্র। তার ফলে পাকিস্তানের অঙ্গ ছেদ হয়েছে। তাদের এই নিন্দনীয় মনোবৃত্তি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ ও স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অবমাননা করা হয় বলে এর বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নিন্দা জানানো উচিত। এখন পর্যন্ত এ জন্য যেমন পাকিস্তান শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা করে নি, তেমনি তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়ে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয় নি। এটা তাদের শোচনীয় এক অবস্থান।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ আদালতের চলমান বিচার ও পাকিস্তানের সহযোগীদের বিচারের বিষয়ে মানহানিকরভাবে নিন্দা জানাবে পাকিস্তান এটা বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নয়। সর্বোপরি, এসব সহযোগী নিজেদের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের প্রতি অনুগত হিসেবে দেখেছে। কর্তৃত্ব ব্যবহার করে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থন করে এমন ব্যক্তিদের হত্যা, লুট ও ধর্ষণ চালিয়েছে। তাদের বর্বরতা, বিশেষ করে হিন্দু ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি যে বর্বরতা চালানো হয়েছে তার কোন সীমা নেই। এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে এসব সহযোগীর বিচার হচ্ছে, যা তাদের প্রাপ্য ছিল।
কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ইসলামিকরণের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দেয়া হয়। ইসলামকে বানানো হয় রাষ্ট্রীয় ধর্ম। আরও হতাশার বিষয় হলো, যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরার সুযোগ দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয় তাদেরকে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে দেয়া হয়। তাদের অনেকে সরকারের উচ্চ পদ দখল করে।
ইসলামিকরণের এই ধারা পাল্টানো প্রয়োজন। তা না হলে পাকিস্তানের পথে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশের। স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপনা এখনও টিকে আছে তা দেখিয়েছে জনপ্রিয় শাহবাগ আন্দোলন। কিন্তু বাংলাদেশি ব্লগার ও বোদ্ধাদের ওপর কট্টরপন্থিদের বার বার হামলা ঝুঁকির বিষয়কে তুলে ধরে। বাংলাদেশে মৌলবাদী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে সামাজিক যুদ্ধ প্রয়োজন। এর প্রেক্ষিতে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির নিন্দা জানানোর মাধ্যমে ইসলামাবাদ যা করেছে তার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একে স্বাগতম।
বাংলাদেশকে ভয়ভীতিহীনভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে নিতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মেজাজ, যা ১৯৭১ সালে পুরো প্রজন্মকে আচ্ছাদিত করেছিল।