খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ

মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা পলাতক জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একাত্তরে তিনি রাজাকার বাহিনীর নগরকান্দা এলাকার কমান্ডার ছিলেন। ‘খোকন রাজাকার’ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। তার বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টিতে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া চারটিতে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৪০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। সবগুলো দণ্ড মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক। রায়ে বলা হয়, জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১১ অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। ২, ৩, ৪ ও ১১ নম্বর অভিযোগে আটক, ধর্ষণ, ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পরামর্শ ও সহযোগিতার দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আনা ১ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
খোকনকে গ্রেফতার বা তার আত্মসমর্পণের পর সাজা কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে যদি তিনি আÍসমর্পণ করেন অথবা গ্রেফতার হন তাহলেই কেবল তিনি রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাবেন।
১০৯ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আমরা মৌখিক ও ডকুমেন্টারি সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে পুরোপুরি বিশ্বাস করি যে, জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকার বাহিনীর একজন সক্রিয় ও প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। অন্যথায় তিনি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার সময় সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে আসতেন না। রাজাকার হিসেবে তিনি অপরাধ সংঘটন করেছেন। তিনি নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র হওয়া সত্ত্বেও বিচার শুরু হওয়ার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন। এ থেকেই অনুমান করে নেয়া যায় যে, তিনি যদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত না থাকতেন তাহলে ট্রাইব্যুনালে এসে বিচারের মুখোমুখি হতেন।
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের হয়ে কাজ করা খোকন স্বাধীনতার পর বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান। বর্তমানে নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি তিনি। ১০ বছর ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিন বছর আগে নির্বাচনে জিতে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র হিসেবে শপথ নেন ৬৬ বছর বয়সী খোকন। পলাতক খোকন এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তবে সুইডেনপ্রবাসী বাংলাদেশীদের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে বড় ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে রয়েছেন খোকন।
পলাতক খোকনের রায়টি ছিল ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত ১২তম রায়। আর পলাতক আসামির দিক থেকে তৃতীয় মামলার রায় এটি। এর আগে দুটি মামলায় পলাতক তিনজনকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং নবম রায়ে একাত্তরের দুই বদও নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। পলাতক থাকায় তারা কেউ আপিলের সুযোগ পাননি।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, জাহিদ হোসেন খোকন নিজেকে রাজাকার বলতে গর্ববোধ করেন। একাত্তরে ফরিদপুরের নগরকান্দায় যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন ট্রাইব্যুনালে আমরা সেগুলো প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সে কারণেই ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।
অন্যদিকে রায়ের পর আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর বলেন, আজকের রায়ে আমি খুশি নই। ১৯৭১ সালে আমার আসামি আনসার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তখন তিনি কেএম ওবায়দুর রহমানের দলে রাজনীতি করতেন। পরে তিনি কেএম ওবায়দুর রহমানের দল থেকে এমপি পদে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না। আমার আসামি ন্যায়বিচার পাননি। এখন উচিত তার আত্মসমর্পণ করে আপিল করা।
তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে সাফাই সাক্ষ্য দিতে পারলে প্রমাণ হতো আমার আসামি এ অভিযোগগুলোর সঙ্গে জড়িত নন।
২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে গত বছরের ২৮ মে পর্যন্ত জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়। ওই বছরেরই ২৯ মে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই অভিযোগ আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে খোকনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গত বছরের ১৪ আগস্ট জাহিদকে পলাতক ঘোষণা করে তার অনুপস্থিতিতেই মামলার কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক থাকায় তার পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৯ অক্টোবর জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২১ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ২৪ জন। আসামিপক্ষে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। ১৭ এপ্রিল চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে রায় ঘোষণা করা হয়। রায় উপলক্ষে ট্রাইব্যুনাল চত্বরে নিরাপত্তার তেমন কড়াকড়ি ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা, বিচারপ্রার্থীসহ গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতি ছিল অন্যান্য রায়ের দিনের তুলনায় অনেক কম। ট্রাইব্যুনাল-১-এ আরও দুটি মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে ২ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মো. মোবারক হোসেনের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে একটি মামলা। ২০ আগস্ট এ ট্রাইব্যুনালে সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। এ তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যে কোনো দিন।
সাজেদা চৌধুরীর সন্তোষ : খোকন রাজাকারের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, খোকনসহ এ এলাকার তিন রাজাকারের রায়ের মধ্য দিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকা তথা নগরকান্দা, সালথা ও কৃষ্ণপুর কলঙ্কমুক্ত হল।