ঘাটে ঘাটে ওসির মাসোয়ারা

দোহার থানা যেন পুলিশের জন্য সোনার খনি। সোনার খনি মানেই টাকার খনি। ঘাটে ঘাটে ঘুষ মাসোয়ারার ফাঁদ। রাজধানীর নিকটবর্তী এই পুলিশ-থানার মাসিক অলিখিত আয় অর্ধকোটি টাকার বেশি। এসব টাকা আসে বিভিন্ন খাতে বেঁধে দেয়া মাসোয়ারা থেকে। হাট, ঘাট, বাজার, আড়ৎ, মাদকের আস্তানা, বাস টার্মিনাল, খেয়াঘাটসহ মাসোয়ারা আদায়ের অগণিত খাত। থানার নয়াবাড়ী, কুসুমহাটি, রাইপাড়া, সুতারপাড়া, নারিশা, মুকসুদপুর, মাহমুদপুর ও বিলাসপুরে মাসোয়ারা আদায়ের জন্য বেশ কয়েকজন এসআইকে অলিখিতভাবে দায়িত্বও দেয়া আছে। এ কাজে রয়েছে ওসি মাহমুদুল হকের নিজস্ব কিছু দালালও। যারা ওসির নামে বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আদায় করে। এরা টাকার বিনিময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে দেয়ার দালালিও করে থাকে। দোহার এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগী মহলসহ বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, দোহারের ওসি মাহমুদুল হকের বাড়ি নওগাঁয়। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রয়াত একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে গর্ব করে অনেকের কাছে বলে বেড়ান। এছাড়া ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছাড়াও আরও উপরের মহলে রয়েছে হট কানেকশন। আর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক তো আছেই। ফলে তিনি ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করেন প্রতিনিয়ত। এর খেসারত দিতে হচ্ছে দোহারবাসীকে। ঘুষ-দুর্নীতি ও নির্যাতনের খক্ষ চাপিয়ে দিয়ে দিব্বি তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।মাসোয়ারা খাত : ওসি মাহমুদুল হক দোহারের প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র জয়পাড়া (দেবীনগর) বাজার থেকে দৈনিক ৫ হাজার টাকা করে নেন। বাজার পরিচালনা কমিটির এক সদস্য জানান, সম্প্রতি বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদককে থানায় ডেকে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা করে দিতে বলেন। সাধারণ সম্পাদক বাজার কমিটি সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলে কমিটির অপর সদস্যরা এর বিরোধিতা করেন। পরে তারা পুলিশের হয়রানির ভয়ে ৫ হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।দোহারের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র মেঘুলা বাজার থেকে নেন মাসে এক লাখ টাকা; কাচারি ঘাট থেকে প্রতি মাসে নেন ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া জয়পাড়া, মেঘুলা, মৈনটঘাট, নারিশাসহ বিভিন্ন বাজার কমিটির নেতা ও বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে থানায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ইস্যু বাবদ মোটা অংকের টাকা আদায় করেন ওসি।সূত্র জানায়, ওসি মাহমুদুল হকের ঘুষ বাণিজ্য বা মাসোয়ারা নেয়ার বড় একটি উৎস পরিবহন খাত। প্রতি মাসে গুলিস্তান-দোহার রুটের আরাম পরিবহনের কাছ থেকে ৩০ হাজার, নগর পরিবহন ২০ হাজার, জয়পাড়া পরিবহনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, যমুনা পরিবহনের কাছ থেকে ১৫ হাজার ও গতি পরিবহনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে আদায় করেন। খাতাকলমে এর প্রমাণ না থাকলে এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে। এছাড়া দোহার এলাকায় ব্যাটারিচালিত এক হাজারে বেশি ইজিবাইক চলে। এগুলোর কোনো ফিটনেস বা লাইসেন্স নেই। তাই থানা পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়েই এসব গাড়ি চালাতে হয়। নির্দিষ্ট সুপারভাইজারদের মাধ্যমে ওসির জন্য দৈনিক ১০ টাকা হারে আদায় করা ইজিবাইক মালিক চালকদের কাছ থেকে। ইজিবাইক খাত থেকে মাসে আদায় তিন লাখ টাকা। এর সিংহভাগই নেন ওসি। কিছু টাকা ব্যয় করেন তার সোর্স ও দালালদের পেছনে। আবার অবৈধ যানবাহন ধরার অভিযানের নামে চেকপোস্ট বসিয়ে ইজিবাইক আটক করা হয়। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে পরে ছেড়ে দেন ওসি। মুকসুদপুরের ইজিবাইক মালিক আবদুল মজিদ যুগান্তরকে জানান, চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি ঢাকা থেকে ৩টি নতুন ইজিবাইক কিনে এলাকায় নিয়ে যাচ্ছিলন। পুলিশ গাড়ি তিনটি আটক করে দেড় লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে চোরাই গাড়ি বলে থানায় মামলা ও গাড়িগুলো ডাম্পিং করার হুমকি দেয়। পরে মজিদ হাতে-পায়ে ধরে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান।সূত্র আরও জানায়, পদ্মার চর মোকসেদপুর থেকে বাহ্রা ঘাট পর্যন্ত এলাকা ওসির আয়ের আরেকটি বড় উৎস। ওই এলাকায় ব্যাকহো ও ড্রেজারের মাধ্যমে বালুমহাল থেকে বালু তোলা হয়। এসব বালুমহাল থেকে ওসি নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে প্রতি মাসেই বড় অংকের মাসোয়ারা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।দোহারের ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, ওসির মাসোয়ারা আদায়ের অন্যতম আরও একটি খাত জুয়ার আসর। মাহমুদপুর আবাসনের পেছনের এলাকা মৈনটঘাট সংলগ্ন নদীর তীরে প্রতিদিন জুয়ার আসর বসে। বোর্ড বসিয়ে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা হয়। ওসি সেখান থেকে মোটা অংকের মাসোয়ারা নেন। জুয়ার আরেকটি বড় আসর বসে পালামগঞ্জ বাজার এলাকায়। সেখান থেকেও মোটা অংকের মাসোয়ারা পান ওসি। এছাড়া পদ্মা ও পদ্মার শাখা নদীতে ভাসমান নৌকা এবং ট্রলারে জুয়ার আসর বসানো হয়। সেখান থেকেও মাহমুদুল হক কমিশন পান বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিশন না পেলেই লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ।স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, দোহারের নারিশা ঘাটে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকাকালীন মাছ বিক্রির মৌখিক অনুমতি দিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন ওসি। এছাড়া প্রতি মাসে মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের মাসোয়ারাও নিয়ে থাকেন। সম্প্রতি র‌্যাব-১১ এর একটি টিম অভিযান চালিয়ে মাছ আটক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ভ্রম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেন। ওই সময় আটককৃত ব্যবসায়ীরা ওসির কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েছেন বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন।পদ্মাপাড়ের মৈনটঘাট ও নারিশা বাজারে রয়েছে মাছের বড় আড়ৎ। মৈনটঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আনিসের মাধ্যমে মৈনটঘাট থেকে দৈনিক ৫ হাজার টাকা হারে আদায় করেন ওসি। এছাড়া পদ্মায় মাছ শিকার করতে যাওয়া মাঝিদের কাছ থেকেও ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে ওসি নগদ টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।সূত্র জানায়, দোহারের চরাঞ্চলে ওসির নির্ধারিত কিছু এজেন্ট রয়েছে। তাদের মাধ্যমে মোটা অংকের মাসোয়ারা নেন থানার ওসি। মাহমুদপুর ইউনিয়নে এই সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব আলী। তার প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেন যুবলীগের মো. শহীদুল ইসলাম। গত এক মাসে মাহমুদপুরের চরাঞ্চলের নিরীহ লোকজনকে বেশ কিছু মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করেন ওসি। অভিযোগ রয়েছে, এসবের নির্দেশদাতা ছিলেন আইয়ুব আলী। সম্প্রতি ওসির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মৈনটঘাট বাস টার্মিনাল দখল করে নেন এই আইয়ুব আলী গং। এর আগে টার্মিনাল দখলে ছিল যুবলীগ নেতা হান্নানের। এই বাসস্ট্যান্ড দখলে রাখতে প্রতি মাসে ওসিকে মাসোয়ারা দেন।অবিশ্বাস্য হলেও সত্য হত্যা মামলার আসামি ও দাগি সন্ত্রাসীদের কাছ থেকেও মাসোয়ারা নেন ওসি মাহমুদুল হক। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই দোহারের লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামের জামাল মুন্সি হত্যা মামলার আসামিদের সঙ্গে তাকে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। বিগত জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের পর বিলাসপুরে ট্রিপল মার্ডারের আসামিদের সঙ্গেও ওসির সখ্যের খবর পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকেও প্রতি মাসে মাসোয়ারা নেন বলে বাদী পক্ষের লোকজন অভিযোগ করেছেন।এসব প্রসঙ্গে ওসি মাহমুদুল হক বলেন, দোহার এলাকায় আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভালো। পুলিশি তৎপরতার কারণে থানায় মামলার সংখ্যা অনেক কম। নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে তাকে জানানোর কথা বলেন তিনি।