সিটি ব্যাংকে পারটেক্স গ্রুপের স্বেচ্ছাচারিতা

বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকে পারটেক্স গ্র“পের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। কর্পোরেট ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ব্যাংকটি এখন পরিণত হয়েছে পারিবাবিক প্রতিষ্ঠানে। দেশের আইন-কানুন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে খেয়ালখুশি মতো প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুবেল আজিজ।
নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজনের বেশি থাকা যায় না। কিন্তু সিটি ব্যাংকে ১৪ পরিচালকের মধ্যে এক পরিবারেরই রয়েছেন ৫ জন। তারা হলেন- চেয়ারম্যান রুবেল আজিজ, সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান পরিচালক আজিজ আল কায়সার, পরিচালক আজিজ আল মাহমুদ, তাবাসসুম কায়সার এবং সৈয়দা শায়রিন আজিজ। বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংখ্যা দুজনের মধ্যে নামিয়ে আনার জন্য সর্বশেষ সময় বেঁধে দিয়েছিল ৩০ অক্টোবর। কিন্তু সে নির্দেশও আমলে নেয়নি তারা।
দৈনন্দিন কাজে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে মাহমুদ সাত্তারকে চাকরি হারাতে হয়েছিল। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্বাস গ্রুপকে ঋণ দেয়া এবং ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ব্যাংকটির একাধিক অনিয়ম ধরা পড়েছে। পারটেক্স গ্র“প ব্যাংক কোম্পানি আইনের তিনটি ধারার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ ব্যাংকে অবাধে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিবারতন্ত্র : পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুই সদস্যের বেশি না থাকার বাধ্যবাধকতা মানছে না সিটি ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তিন দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তারা তা আমলে নেয়নি। একই পরিবারের ৫ সদস্যকে পর্ষদে রাখার জন্য ভিন্ন এক কোম্পানির নামে একজন পরিচালককে নিয়োগ দিয়ে আইনকে শুভংকরের ফাঁকি দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি মেনে নেয়নি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে ৮৩৪ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ ব্যাংকটিতে উদ্যোক্তাদের মোট শেয়ার ৩১ দশমিক ২২ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৫৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে একই পরিবারের ওই ৫ পরিচালকের সম্মিলিত শেয়ার ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ। উদ্যোক্তা শেয়ারের মধ্যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের রয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৫ হাজার ৯০৮টি, যা ব্যাংকের মোট শেয়ারের ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, তার স্ত্রী সৈয়দা শায়রিন আজিজের ২ দশমিক ০১ শতাংশ এবং ভাই আজিজ আল কায়সারের ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। এছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরিচালক আজিজ আল মাহমুদের ২ শতাংশ এবং তাবাসসুম কায়সারের ২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের কাছে কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার রাখা যাবে না। কিন্তু ওই পরিবারের কাছে রয়েছে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ শেয়ার। ওই আইন লংঘনের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমুদয় বা অতিরিক্ত শেয়ার বাজেয়াপ্ত করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ওই ধারা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
আইন লংঘন : ব্যাংক কোম্পানি আইন (সংশোধন)-২০১৩ এর ধারা ১৫-এর উপধারা (১০)-এ বলা আছে, বলবৎ অন্য কোনো আইন অথবা কোনো ব্যাংক- কোম্পানির সংঘস্মারক ১ (এক) বৎসর অতিবাহিত হইবার পর হইতে কোনো একক পরিবার হইতে দুই জনের অধিক সদস্য একই সময়ে কোনো ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবে না। আইনটিতে এ উপধারার ব্যাখ্যা দেয়া আছে এভাবে, এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে পরিবারের সদস্য হিসেবে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সকলেই অন্তর্ভুক্ত হইবেন। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০১৩ পাস হয়েছে গত বছরের ২২ জুলাই। সে হিসেবে ২০১৪ সালের ২২ জুলাই এক বছর পার হয়েছে। আর এ উপধারাটিও কার্যকরী হয়েছে। তাই এখন কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজনের বেশি সদস্য পরিচালক হিসেবে থাকলে তা হবে অবৈধ।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী একই সময়ে কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুবেল আজিজ একই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসিরও পরিচালক, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লংঘন। এ বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তারা তা মানছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য : এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। যারা নিয়ম মানছে না বা নিয়ম না মেনে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। এর পরও কেউ অবস্থান ঠিক না করলে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
এমডির বিদায় : ব্যাংক কোম্পানি আইন মোতাবেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা ব্যাংকের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু রুবেল আজিজ তা মানতে নারাজ। তাই তার নির্দেশ ছাড়া ব্যাংকের সামান্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ছিল না কে মাহমুদ সাত্তারের। এক পর্যায়ে কে মাহমুদ সাত্তার চেয়ারম্যানের কাজের বিরোধিতা করলে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন রুবেল আজিজ।
সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে কে মাহমুদ সাত্তার সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। তখন আজিজ আল কায়সার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু পরে চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের সঙ্গে কোনোভাবে মিলে কাজ করতে পারছিলেন না তিনি। সূত্র বলছে, রুবেল আজিজ ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে রীতিমতো নাক গলাতে শুরু করেন। এমনকি তিনি ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনেও খামখেয়ালিপনা করেন। নিকটজন ও পরিচিত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ দিতেই তিনি বেশি আগ্রহ বোধ করেন।
ঋণ জালিয়াতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঋণ জালিয়াতি করে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস গ্র“পকে ৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় ব্যাংকটি। আর সাবেক চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সারের এ সিদ্ধান্তে ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ঋণ দেয়া হয়। পরবর্তীকালে বর্তমান চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের সিদ্ধান্তে আবার সেই ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বাস গ্র“পের যে আট প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ দেয়া হয়েছিল তার সবগুলোই নামসর্বস্ব। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কখনোই চালু হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৬৫ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিটি ব্যাংকের কাছে গ্র“পটির যে সম্পদ বন্ধক আছে, তার বাজারমূল্য সাকুল্যে ১৬ কোটি টাকার মতো। এছাড়া ব্যাংকের একক ঋণসীমা ছিল ৪০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ সীমা অতিক্রম করে ঋণ দেয়া হয়েছে।
কার্ড জালিয়াতি : গত দেড় বছরে ব্যাংকটি থেকে গ্রাহকের ক্রেডিট ও ডেভিড কার্ডের ৬ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আÍসাতের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটি বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকের অজ্ঞাতে টাকা তুলে নেয়। পরে গ্রাহকের কোনো অভিযোগও আমলে নেয় না। এভাবে গ্রাহকের অজান্তে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংকটির খেলাপি ও অবলেপন মিলিয়ে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫৯৩ কোটি এবং অবলেপন ৯৯৭ কোটি টাকা।
কে এই রুবেল আজিজ : রুবেল আজিজ হলেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ী পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ হাশেমের ছেলে। সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছাড়াও বর্তমানে তিনি আইডিএলসির পরিচালক ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান। রুবেল আজিজ পারটেক্স গ্র“পের বেশ কয়েকটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেও রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পারটেক্স বেভারেজ, পারটেক্স জুট মিল, পারটেক্স প্লাস্টিক, পারটেক্স এক্সেসারিজ। এছাড়া তিনি পারটেক্স অ্যাম্বার কটন মিলস, পারটেক্স সুগার মিলস, পারটেক্স ডেনিমের পরিচালক। তিনি জড়িত রয়েছেন জনতা ইন্স্যুরেন্স, বনানী ক্লাব অ্যান্ড বনানী সোসাইটি এবং ইবাইস ইউনিভার্সিটির সঙ্গেও।