বিএনপির রাজনীতিতে আঁতাত ফ্যাক্টর : হতাশা তৃণমূলে


ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ‘আঁতাতের’ রাজনীতি করছেন ফরিদপুর বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কয়েকজন নীতিনির্ধারণী নেতা। বিনিময়ে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। হামলা-মামলা থেকে নিজেদের রেখেছেন নিরাপদ। অন্যদিকে যেসব নেতাকর্মী মাঠে নেমে সরকারবিরোধী আন্দোলন করছেন তারা শিকার হচ্ছেন হামলা, মামলাসহ নানা হয়রানির। কেউ কেউ জেল খেটেছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে রয়েছেন আত্মগোপনে। এসব কারণেই ফরিদপুরে বিএনপি সরকারবিরোধী বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বলে মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, কিছু নেতার আঁতাতের রাজনীতির কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি কেন্দ্র ঘোষিত দলীয় কর্মসূচি পালনের আগে সরকারি দলের নেতাদের অনুমতি নেন এসব নেতা। বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কিছু নেতার আঁতাতের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও বিপর্যস্ত ফরিদপুর জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো। ফরিদপুর জেলা শহরে বিএনপির দলীয় কোনো কার্যালয় নেই। হাট-বাজার, চায়ের দোকান, নেতাদের বাসাবাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। ৫ বছর ধরে দলের কাউন্সিল হচ্ছে না। দুই দফায় উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। দলটির নিবেদিতপ্রাণ নেতারা জানান, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা ও হামলা-মামলার ভয়ে জেলার সিনিয়র নেতারা সরকারবিরোধী বড় আন্দোলনে নামতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, ফরিদপুরের আন্দোলনে সরকারের পতন হবে না। সুতরাং আন্দোলন-সংগ্রাম করে লাভ হবে না। উল্টো হামলা-মামলার শিকার হতে হবে বলে কর্মীদের সাফ জানিয়ে দেন তারা। এ নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেক নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সহসভাপতি শহীদ পারভেজ বলেন, বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত থাকায় সরকারবিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের আগে সরকারি দলের নেতাদের জানিয়ে মৌখিক অনুমতি নেন তারা। সরকারি দলের পরামর্শ অনুযায়ী স্বল্প পরিসরে আন্দোলন পরিচালিত হয়। তিনি আরও বলেন, দলের বেশিরভাগ অঙ্গসংগঠনের নেতা জেলা কমিটির সঙ্গে রয়েছে। তবুও বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না।একই ধরনের অভিযোগ করে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক একেএম কিবরিয়া স্বপন বলেন, জেলা কমিটির কয়েকজন নেতা সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। নিজেদের নিরাপদে রাখতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে তারা সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করছেন। এ কারণে বেশিরভাগ নেতাকর্মী জেলা কমিটির সঙ্গে নেই। জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ও সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদ তাবরীজ একই ঈঙ্গিত দিয়ে বলেন, সরকারি দোকানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা। আঁতাতের রাজনীতি করায় তারা নিরাপদে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও হয় না। অথচ মাঠে আন্দোলনকারী নেতাকর্মীরা পুলিশি হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন। অনেকে জেল খেটেছেন। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে জেলা বিএনপি কঠোর কর্মসূচি পালন করতে পারে না।জেলা বিএনপির সভাপতি মো. জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া বলেন, ‘আমি সরকারের সঙ্গে কোনো আঁতাত করিনি। এ কারণে আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আমার জুটমিল ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। যারা আঁতাত করে চলে তারা ভালো আছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমি নেতৃত্ব দেই। আমার সঙ্গে বেশি লোকজন নেই এটা সত্য। তবে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, মহিলা দলসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী আমার সঙ্গে রয়েছেন।’ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা বলেন, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কিছু লোক দলের বিরুদ্ধে কাজ করেন। তাদের সঙ্গে জেলা কমিটির দূরত্ব রয়েছে। যারা আমাদের বিরুদ্ধে আঁতাতের অভিযোগ করেছেন দলে তাদের কোনো অবস্থান নেই। দলীয় কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় দলে ছোটখাটো কিছু সমস্যা থাকে। ফরিদপুরেও এ সমস্যা রয়েছে।তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মূলত বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ও জেলা বিএনপির সভাপতি মো. জহিরুল হক শাহজাদা মিয়ার নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। জেলা কমিটির নেপথ্যে রয়েছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। বেশিরভাগ দলীয় কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম আলাদাভাবে পালন করেন দলটির নেতাকর্মীরা। আবার উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলোতে রয়েছে নানা গ্র“প। এসব কারণে দলের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জেলার সিনিয়র নেতারা সংগঠনকে শক্তিশালী করার বদলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বেশি ব্যস্ত। চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী থাকায় ফরিদপুরে তার সমর্থক সংখ্যা বেশি। তার সমর্থকদের আশা, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিনি আবারও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবেন। এ কারণে দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তার সঙ্গে রয়েছেন। অপরদিকে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে বর্তমান কমিটির বেশিরভাগ সদস্য রয়েছেন। যদিও এই কমিটি গঠন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কমিটির বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে কয়েকবার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় কয়েকজন নেতা।বেকায়দায় সাধারণ নেতাকর্মীরা : বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আঁতাত করায় নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন দলের সিনিয়র নেতারা। তাদের বিরুদ্ধে তাই মামলা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন। নিচ্ছেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা। সর্বশেষ গত উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে গোপনে কাজ করেছেন জেলা কমিটির সিনিয়র কয়েকজন নেতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুরের বিতর্কিত সরকারি তিতুমীর মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছার স্ত্রী, আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন মৃধার স্ত্রী, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক একেএম কিবরিয়া স্বপনসহ বেশ কয়েকজন নেতা। অপরদিকে যেসব নেতাকর্মী সরকারবিরোধী আন্দোলন, দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নেন তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। অনেককে জেলে যেতে হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা-মামলার ভয়ে বিপুলসংখ্যক কর্মী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির জেলা সভাপতি মো. জহিরুল হক শাহজাদা মিয়াসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছার বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা হয়েছে। অপরদিকে জেলা যুবদল সভাপতি আফজাল হোসেন খান পলাশের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা ও সাধারণ সম্পাদক একেএম কিবরিয়া স্বপনের বিরুদ্ধে ১০টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক জুলফিকার হোসেন জুয়েলের বিরুদ্ধে ১৭টি, জেলা ছাত্রদল সভাপতি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বেনজির আহম্মেদ তাবরীজের বিরুদ্ধে ১১টিসহ বিএনপির আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।