কার লাভ কার ক্ষতি স্বপ্ন সংশয়ে কিউবা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আকস্মিক ঘোষণায় একইসঙ্গে বিস্মিত ও হতভম্ব হাভানার অধিবাসীরা। পুরাতন বোতলে হঠাৎ নতুন মদের মাদকতায় কে দুলবে- কে পড়বে কার লাভ- কার ক্ষতি এমন বহুমুখী চিন্তায় বৃহস্পতিবার কিউবার অধিবাসীদের সারাদিনটাই কেটেছে স্বপ্ন ও সংশয়ে দোটানায়। কিউবানরা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি আসলে কী হতে যাচ্ছে। সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিস্তারিত মানে খুঁজে ফিরছে তারা।
আমি এখনও স্তব্ধ! খবরটা নিয়ে এখনও চিন্তা করছি বললেন রোনালদো রদ্রিগেজ (৪৪)। রাজধানীর ভেদাদো জেলায় গাড়ি পরিষ্কারের কাজ করেন তিনি। রোনালদো বলেন, সত্যিই আমি এই ধাঁধার রহস্য এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো এই ঐতিহাসিক খবরটা বুধবার খুব সংক্ষেপে জানিয়েছেন। আমাদের পত্রিকায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু আসেনি। স্নায়ুযুদ্ধকাল হতে শত্রুতার জালে জড়িয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্র-কিউবার সম্পর্কের শীতলতা নাটকীয়ভাবে উষ্ণতায় ফিরেছে যখন মার্কিন এজেন্ট অ্যালন গ্রসকে মুক্তি দিয়েছে হাভানা। অন্যদিকে কিউবার তিন গুপ্তচরকে মুক্তি দিয়েছে ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকা থেকে কিউবার নাম বাদ দেয়ার ব্যাপারে বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছে পাঁচ দশকের বেশি সময় (৫৩ বছর) পর হাভানায় আবার দূতাবাস খোলার ঘোষণা দিয়েছেন ওবামা।এবার নোবেল পাওয়ার যোগ্য হলেন ওবামাটেলিভশনের সামনে আনন্দাশ্র“ ফেলে উল্লাস করছেন ৬২ বছল বয়সী ম্যানুয়েল রামোস। ৫৪ বছর আগে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিপ্লবের সময় তার বাবা-মা কিউবা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এখন তিনি চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বজনরা আসতে পারবেন। এই অঞ্চলে এতদিনে শান্তি আসবে। ট্যাক্সি ড্রাইভার ইয়োরদানিস হেরেরা বলেন, এবার আমাদের অনেক উন্নতি হবে। আমেরিকা থেকে টাকা আসবে। ইলেকট্রিশিয়ান আরমানদো রদ্রিগেজ (৪৯) আশা করেন এখন দেশে আমেরিকার বিনিয়োগ হবে, পর্যটকরা আসবে। এতে অনেক লাভ হবে। তিনি বলেন, এবার ওবামা নোবেল পাওয়ার যোগ্য হয়েছেন। ২০০৯ সালে যখন ওবামা শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন, তখন তার এই সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।নতুন বিপ্লবের জন্য কিউবা কতটা প্রস্তুত?কিউবার ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বপ্ন দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে দেশটি ব্যাপক উন্নতির পথে যাবে। কঠোর কমিউনিস্ট শাসনের আষ্টেপৃষ্টে আর ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক অবরোধে মৃতের মতো দেশটি নতুন করে চাঙা হয়ে উঠবে। কিন্তু নতুন এই বিপ্লবের জন্য কতটা প্রস্তুত কিউবা? বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের পথে উঠলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা কিছুই পাবে না কিউবানরা। ২০০৮ সালে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কাছ থেকে যখন তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রো দেশের ক্ষমতা নিলেন, তখন থেকে বেশ কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। পাঁচ লাখ শ্রমিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পেলেন। প্রথমবারের মতো নিজের বাড়ি ও গাড়ি কেনার অধিকার পেলেন কিউবানরা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের ফলে দেশটিতে আমেরিকান বিনিয়োগ ঘটবে। দেশটির টেলিকমিউনিকেশন খাতে বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশটির মাত্র ৫ শতাংশ জনগণ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ। গত বছর শুধু ই-মেইল ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তাই মানবাধিকার, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সামগ্রিক জীবনমানের উন্নয়নে কতটা অগ্রগতি হবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত। তবে ফিদেল ক্যাস্ত্রো যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোর হাতে তা নতুনভাবে আবর্তিত হয়ে উন্নতি ও প্রগতির পথে যাবে এমনটাই মনে করছেন দেশটির নতুন প্রজন্ম।হাভানার পর্যটন, ওয়াশিংটনের টেলিকম৫৩ বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর সম্প্রতি কিউবা এবং আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা উঠানোয় কিউবা কিংবা আমেরিকার অর্থনীতিতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন দেশ প্রকৃতপক্ষে বেশি লাভবান হবে তা নিয়ে রয়েছে আলোচনা ও বিতর্ক। উভয় দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখনও কিউবার বেশির ভাগ ব্যবসা, শিল্প, অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। তারপরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে (যদিও অর্থনীতির সূচকে এই ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে কিছু নেই) ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হয়তো লাভবান হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমেরিকাস সোসাইটি এবং কাউন্সিল অব দ্য আমেরিকাসের পলিসি ডাইরেক্টর ক্রিস্টোফার সাবাতিনি বলেন, আমরা কিউবায় খুব বড় ধরনের কার্যকারিতা কিংবা অর্থনৈতিক পরিবর্তন আশা করি না। সাবাতিনি আরও বলেন, কিউবা কোনোভাবেই বিনিয়োগের জন্য কোনো স্বর্গ নয়। কেননা আগামী বছর নাগাদ কিউবার অর্থনীতি ৩% বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।তবে এখন থেকে কিউবান আমেরিকান ৫০০ ডলারের পরিবর্তে ২০০০ ডলার পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে নিজ দেশে পাঠাতে পারবেন। ফলে জনগণের স্পেন্ডিং পাওয়ারের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবর্তন হবে। তবে, কিউবার পর্যটন শিল্পে ব্যাপক উন্নতি হবে। কেননা এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে কিউবার ট্র্যাভেলস ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে। এতে উভয় দেশের ট্যুরিস্ট লাভবান হবে। এদিকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে একজন আমেরিকান কিউবা থেকে ৪০০ ডলার পর্যন্ত জিনিস কিউবা থেকে নিয়ে যেতে পারবেন যার মধ্যে অবশ্য ১০০ ডলারের অ্যালকোহল সামগ্রী থাকবে। অবশ্য এই ১০০ ডলারের ভেতরে কিউবার বিখ্যাত রম এবং সিগারও থাকছে।এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে আমেরিকার টেলিকমস ইন্ডাস্ট্রি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। কেননা বারাক ওবামার প্রশাসন জানে কিউবাতে এখনও টেকনোলজির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। আমেরিকা সেই সুযোগে কিউবাতে টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিপুল পরিমাণে রেভিনিউ উঠিয়ে নেবে, পাশাপাশি কিউবা এর ফলে টেকনোলজির ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন ও এই সেক্টর উন্নয়নের সুযোগ পেয়ে যাবে। এএফপি, নিউইয়র্ক টাইম, ওয়াশিংটন পোস্ট, টেলিগ্রাফ