সেনা মোতায়েনের দাবি খালেদার

 আসন্ন পৌর নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি অথর্ব, আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন। সরকারি দলের প্রার্থীরা প্রতিনিয়ত আচরণবিধি লঙ্ঘন  করছে। শেখ হাসিনা নিজেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। নির্বাচন কমিশনে এসব অভিযোগ দেয়া হলেও কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হবে। আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে সেনা মোতায়েন করতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী দেবে না। সরকার সেনাবাহিনীকে মাঠে নামাতে চায় না। আমি বলে দিতে পারি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৮০ ভাগ পৌরসভায় ধীনের শীষের প্রার্থীরা জিতবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন সরকারের ফন্দি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, সরকার নির্বাচন ছিনতাই করে দেখাবে জনগণ ধানের শীষের পক্ষে নেই। সব নৌকার পক্ষে। এখানেও সরকারের ষড়যন্ত্র আছে। কিন্তু তারা কি দেখছে নৌকা ডুবতে বসেছে। আমাদের নেতারা যেখানে প্রচারণায় যাচ্ছে সেখানেই মানুষ সাড়া দিচ্ছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কেন্দ্রে যাবেন, আমাদের প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেবেন। ৫ই জানুয়ারির একতরফা জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সে নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। ভোটকেন্দ্রে কুকুর শুয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করে তাহলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন অংশ নিয়েছে বিএনপি? খালেদা জিয়া বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয়ভাবে। সেখানে নির্বাচনের একটি আলাদা আমেজ আছে। সাধারণ মানুষ সেই ভোটে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচনে কিছুটা হলেও সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল সেখানে আমাদের প্রার্থীরা জিতেছে। কিন্তু সরকার তা সহ্য করতে পারেনি। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার ও বরখাস্ত করেছে। নির্বাচিতদের বাদ দিয়ে অনির্বাচিতরাই দেশ চালাচ্ছে, নতুন নতুন আইন করছে। তিনি দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের উদ্দেশে বলেন, আসুন আমরা সবাই আরেকবার জেগে ওঠি। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের দিতে তাকাই। নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে এগিয়ে চলার সুযোগ করে দিই। সবাই জেগে ওঠলে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে শামিল হলে অত্যাচারি বিদায় হবে, দেশে শান্তি ফিরে আসবে। খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা সত্য কথা লেখে তাদের সহ্য করতে পারে না আওয়ামী লীগ। একে খন্দকার বই লেখার পর তাকে বইটি প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিল। সে প্রত্যাহার না করায় তাকে মামলা থেকে শুরু করে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের মেয়েও বই লিখেছেন। অথচ এরা আওয়ামী লীগের কাছের লোক ছিলেন। আর আজ তাদের কাছের লোক হচ্ছে তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি কিন্তু এখন তাদের সহযোগিতা করছে। বর্তমান সরকার নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করছে। বলা হয়- এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। আসলে কত লোক শহীদ হয়েছে? বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, যারা ক্ষমতায় আছেন দেশের প্রতি তাদের কোন মায়া নেই, দায়িত্ব নেই। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা চায়নি, তারা চেয়েছিল ক্ষমতা। তারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। সেদিন জিয়াউর রহমান ডাক না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আপনারাও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধে যারা সহযোগিতা করেছে আমরা তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তিনি বলেন, আমরাও বলেছি বিচার হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সে বিচার হতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেদের ঘরে যুদ্ধাপরাধী পালছে। তারাই যুদ্ধাপরাধীকে প্রথম মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। জামালপুরের রাজাকার মন্ত্রী মাওলানা নুরুল ইসলামের কথা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। তারা আমাদের দোষ দেয় আর নিজেদেরগুলো মুছে ফেলতে চায়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের কোনদিন সম্মান করতে পারেনি। নিজ দলের মধ্যেও যারা সত্য বলেছে তারা অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছে। কিন্তু আমরা ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের উপযুক্ত সম্মান ও সম্মাননা দেয়া হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, নতুন প্রজন্মকে আপনাদের পুরোনো দিনের কথা বলতে হবে। এখন সত্যিকার ইতিহাসের বইপত্র লেখা যায় না, বাজারে পাওয়া যায় না। তাই আপনাদের বলতে হবে আওয়ামী লীগ ১৯৭১-৭৫ সালে কি করেছিল। ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সিরাজ সিকদারকে রক্ষীবাহিনী গঠন করে আটক করা হয়েছিল। তারপর তাকে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের মাধ্যমে আওয়ামীই প্রথম ক্রসফায়ার শুরু করে। সেদিনও মানুষ গুম করাই ছিল আওয়ামী লীগের কাজ। আওয়ামী লীগকে বিশ্লেষণ না করলে বুঝা যাবে না তারা কত হিংস্র। বর্তমানে সারা দেশে গুম, ক্রসফায়ার ও গুলির ঘটনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, সারা দেশে প্রতিদিনই গুম-খুনের ঘটনা ঘটছে। তাদের কি দোষ? তারা কি মানুষ না। তারা কি আমাদের ভাই-বোন না। আজ কারাগারে কত লোক আছে, তার বেশির ভাগই বিএনপির। সরকার এসব করছে বিএনপিকে ধ্বংস করতেই। পিলখানা হত্যাকা ের কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর ফেব্রুয়ারিতেই এতবড় ঘটনা ঘটেছে। এটা ছিল সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়া ও বিডিআরকে ধ্বংস করে দেয়ার একটি পরিকল্পিত ঘটনা। শেখ হাসিনার হাতে রক্ত, রক্ত আর রক্ত। ফেব্রুয়ারিতে রক্তের দাগ লাগার পর থেকে আজও অব্যাহত আছে। আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দিই। নিশ্চয়ই আল্লাহ সময় মতো তাদের বিচার করবেন। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ পুলিশ ও প্রশাসনের লোকদের ভয় দেখায় আমরা ক্ষমতায় গেলে কারও চাকরি থাকবে না। কিন্তু পুলিশের সবাই খারাপ নয়। প্রশাসনের লোকজনও সবাই খারাপ নন। আমরা জানি, তারা কোন দোষ করেনি। দোষ করেছেন শেখ হাসিনা। পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই আমাদের জানায়, তারা অসহায়। উপরের নির্দেশ পালনে তারা বাধ্য হচ্ছেন। অন্যথা হলে তাদের চাকরি থাকবে না, মামলা দিয়ে হয়রানি করবে। তিনি বলেন, আমরা বলতে চাই- বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অন্যায়ভাবে কারও চাকরি যাবে না। দলীয় পরিচয় নয়, যোগ্যতা এবং দক্ষতাই হবে চাকরি ও পদোন্নতির সোপান। আমরা দেশে গণতন্ত্রের ধারা ফিরিয়ে আনব। সুশাসন ও ন্যায় বিচার ফিরিয়ে আনবো। সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, দেশটা আজ কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। পরিণত করা হয়েছে লুটপাটকারীদের স্বর্গরাজ্যে। পদ্মা সেতু তৈরি করা হবে। একটি দুই দুইটি পদ্মা সেতু তৈরির পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। দীর্ঘ ৪৫ মিনিটের বক্তব্যের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের বিভিন্ন ঘটনাপরম্পরা উল্লেখ করে সে সময়কার ক্ষমতা দখলকারীদের নানা নির্যাতনেরও সমালোচনা করেন। এর আগে বিকাল সোয়া ৫টায় মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে যোগ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে তাকে মুক্তিযোদ্ধারা অভ্যর্থনা জানান। পরে মুক্তিযোদ্ধা দলের পক্ষ থেকে তাকে মেডেল ও ক্রেস্ট এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দল থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কিশোরগঞ্জ জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। এছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশসহ বিএনপির শীর্ষ নেতা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা বক্তব্য দেন।