আলোচনায় তেল

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে কয়েক দফা। তেলের মূল্য বর্তমানে গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু দেশের বাজারে সুফল পাননি ভোক্তারা। বরং দীর্ঘদিন উচ্চমূল্যের ওপর স্থির থেকে সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকবার দাম বাড়ানো হয়েছে। গত কয়েক দিনেও পামঅয়েল, সুপার অয়েল ও খোলা সয়াবিন তেলের কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছেন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। বেপরোয়া মুনাফা করছেন তারা। বর্তমানে পামঅয়েলের প্রতি কেজি আমদানিমূল্য মাত্র ৩৭ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। আর সয়াবিন তেলের প্রতি কেজির আমদানিমূল্য পড়ছে ৪৬ টাকা। অথচ ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারের ভোগ্যপণ্যের মূল্য তদারকি প্রতিষ্ঠান ‘ইনডেক্স মুন্ডির’ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে প্রতি টন পামঅয়েলের মূল্য কমেছে ১২২ ডলার ৯২ সেন্ট। আর প্রতি টন সয়াবিন তেলের মূল্য কমেছে ১৪৭ ডলার ৭৯ সেন্ট। অথচ এ সময়ে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমেনি বরং বেড়েছে। ভোজ্য তেলের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ সয়াবিন তেলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে, কিন্তু আরও অনেক খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে খুব বেশি লাভে বিক্রি করতে পারি না। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের ব্যাপকভাবে দাম কমায় দেশের বাজারেও দাম কমা দরকার। বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, ভোজ্য তেলের দাম আরও কম হওয়া দরকার। কিন্তু মিলমালিকরা না কমানোয় বাজারেও কমছে না। কারণ বিশ্ববাজারে এখন ভোজ্য তেলের দাম অনেক কম।
ইনডেক্স মুন্ডির তথ্যে দেখা গেছে, গত জুন থেকে প্রতি মাসেই ভোজ্য তেলের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে জুন মাসে প্রতি টন সয়াবিন তেলের মূল্য ছিল ৭৩৮ ডলার ৪ সেন্ট বা ৫৭ হাজার ৫৬৭ টাকা (১ ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে)। জুলাইয়ে তা নেমে দাঁড়ায় ৬৯৫ ডলার ৭৯ সেন্ট বা ৫৪ হাজার ২৭১ টাকা। আগস্টে প্রতি টনের মূল্য হয় ৬২৮ ডলার ২৫ সেন্ট বা ৪৯ হাজার ৪২ টাকা। আর সেপ্টেম্বরে মূল্য দাঁড়ায় ৫৯০ ডলার ২৫ সেন্ট বা ৪৬ হাজার ৩৯ টাকা।
একইভাবে গত জুনে বিশ্ববাজারে প্রতিটন পামঅয়েলের মূল্য ছিল ৬০৬ ডলার ৪০ সেন্ট বা ৪৭ হাজার ২৯৯ টাকা। জুলাইয়ে মূল্য কমে হয় প্রতি টন ৫৭৫ ডলার ৬৮ সেন্ট বা ৪৪ হাজার ৯০৩ টাকা। আগস্টে দাম হয় ৪৮৪ ডলার ৬৮ সেন্ট বা ৩৭ হাজার ৮০৫ টাকা। আর সেপ্টেম্বরে মূল্য কমে হয় ৪৮৩ ডলার ৪৯ সেন্ট বা ৩৭ হাজার ৭১২ টাকা।
আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববাজার থেকে যে মূল্যে সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় তার সঙ্গে ভ্যাট, বন্দর খরচ ও রিফাইন খরচসহ অন্যান্য খরচ যুক্ত হবে। সে হিসেবে আমদানি মূল্যের সঙ্গে প্রতি কেজিতে যুক্ত হবে আরও ৪ থেকে ৫ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের আমদানিমূল্য ৪৬ টাকা পড়ে এর সঙ্গে ৫ টাকা যোগ করা হলে প্রতি কেজির মূল্য পড়ে ৫১ টাকা। আর প্রতি কেজি পামঅয়েলের মূল্য পড়ে ৪২ টাকা। কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ ও পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। আর সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব মতে, বাজারে এখন প্রতি কেজি সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৪ থেকে ১০০ ও পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। কিন্তু টিসিবির মূল্যের চেয়ে বাজারমূল্য আরও বেশিই থাকে। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ পামঅয়েল ও ৩২ শতাংশ সয়াবিন তেল। বাকি ৩ শতাংশ সরিষাসহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করা হয়। ২০১৪ সালে ১২ লাখ ৬৭ হাজার টন পাম ও ৬ লাখ ২৭ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়। কিন্তু এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকি। পামঅয়েল বেশি আমদানি করা হলেও বাজারে ৮০ শতাংশই সয়াবিন তেল হিসেবে বিক্রি করা হয়।
দেশের বাজারে মূল্য না কমিয়ে দ্বিগুণ লাভ করার বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েকজন আমদানিকারক দেশে আমদানি ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। কারণ আমদানি প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগী থাকলে এমন হতো না। বেশ কিছু পণ্যের দাম সারা বছর ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে আগের বছরের তুলনায় বর্তমানে পণ্যবাজার স্থিতিশীল বলে মনে করেন তিনি।
ভোগ্যপণ্যের মূল্য তদারককারী সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমার বিষয়টি জেনেছি। বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০১১ সালে ট্যারিফ কমিশন ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। চার বছর আগে যেহেতু মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেহেতু এখন নতুন করে আবার মূল্য পুনর্নির্ধারণের সময় এসেছে। তা ছাড়া বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমলে এর সুফল অবশ্যই দেশের ভোক্তার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
এ ছাড়া দেশি মসুর ডাল জানুয়ারিতে ছিল প্রতি কেজি ১০০ টাকা। ৫ দফায় দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। বিক্রেতা বোরহান উদ্দিন বলেন, মসুর ডালে বস্তায় বেড়েছে প্রায় ৬০০ টাকা। আর চিনির বস্তায় বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। চালের দাম বেড়েছে ৩ দফায়। হরতাল-অবরোধের কারণে পণ্যবাহী ট্রাক আসতে পারেনি, সিন্ডিকেট ও পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় চালের দাম বাড়তে থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম বলেন, পাটের বস্তা একদিকে সংকট অন্যদিকে দাম বেশি। প্লাস্টিকের একটা বস্তা কেনা যায় ২০ টাকায়। কিন্তু পাটের বস্তা ক্রয়ে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। এসব বাড়তি দাম চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সব মিলিয়ে বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজার স্থির ছিল না। দফায় দফায় পণ্যের দাম বেড়েছে। বছরের প্রথম তিন মাস হরতাল-অবরোধে ছিল নাকাল। প্রায় ৯০ দিন সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা ছিল বিচ্ছিন্ন। এতে দুই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। একদিকে রাজধানীতে পণ্য অতিমূল্যায়িত হয়। অন্যদিকে গ্রামে টনে টনে পণ্য পচে যায়। ঢাকায় পণ্য পাঠাতে পারেননি বলে অর্থনৈতিকভাবে চরম লোকসানে পড়েন কৃষকরা। কিছুদিন পুলিশি পাহারায় পণ্যবাহী ট্রাক এলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত এবং শেষ পর্যন্ত থেমে যায়। ফলে বেশির ভাগ পণ্য খেতেই নষ্ট হয়েছে। একই সময়ে রাজধানীর ভোক্তারা চড়া দামে পণ্য কিনে খেতে হয়। গ্রামের কৃষক পণ্যের দাম পায়নি। অথচ ঢাকার ভোক্তারা পণ্যের অতি দামে বিরক্ত। এভাবে উভয় পক্ষ ঠকেছে।