চাকরির জন্য লোক ধরাধরি অবমাননাকর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত ডিজিটাল সেন্টার উদ্যোক্তা সম্মেলনে তিনি চাকরির জন্য দুয়ারে দুয়ারে না ঘুরে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, শিক্ষা শেষে চাকরির জন্য এখানে সেখানে লোক ধরাধরি করা শিক্ষিত লোকের জন্য অবমাননাকর। আমরা চাই না যুবসমাজ চাকরির জন্য এখানে সেখানে ঘুরাফেরা করুক। আমরা চাই তরুণ সমাজ নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং অন্য ১০ জনের আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করবে।
প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা না করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হুশিয়ার করেন। উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা কারো কাছে মাথানত করে চলি না। অনেকের অভ্যাস পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ানো। চাকরির জন্য কারো কাছে ধরনা না দিয়ে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এ ডিজিটাল সেন্টার উদ্যোক্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সারা দেশ থেকে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের ১১ হাজার উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়। বেলা ১১টার দিকে শুরু হওয়া এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার সচিব মঞ্জুর হোসেন। অসুস্থতার (জ্বর) কারণে প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনের একদম শেষ পর্যায়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান। এ সময় অনুষ্ঠানের সভাপতি সিনিয়র সচিব মঞ্জুর হোসেন বক্তৃতা করছিলেন। তিনি (সচিব) বক্তৃতা সংক্ষেপ করে তা শেষ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতা শুরু করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ইউএনডিপির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেকটর পাওলিন টেমেসিস। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এছাড়া অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান শিকদার, সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং এটুআই প্রকল্পের পরিচালক কবির বিন আনোয়ার বক্তৃতা করেন। অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বক্তৃতা করেন রাঙ্গামাটির বিকাশ চাকমা ও রংপুরের আরিফুজ্জামান মুন। বিপুলসংখ্যক উদ্যোক্তার উপস্থিতিতে প্যারেড স্কয়ারে গোটা প্যান্ডেল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের কার্যক্রম প্রজেক্টরের মাধ্যমে উপস্থিত সবার জন্য দেখার ব্যবস্থা করা হয়। সম্মেলন উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারসহ আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্মেলন। এরপর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে এখন ৪ হাজার ৫৪৭টি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এছাড়াও ৩২১টি পৌরসভা ও ১১ সিটি কর্পোরেশনের ৪০৭টি ওয়ার্ডে রয়েছে ডিজিটাল সেন্টার।
শেখ হাসিনা বলেন, অন্য দেশগুলোর চেয়ে আমাদের দেশে তরুণের সংখ্যা অনেক বেশি। ভাত-মাছ খেয়ে বড় হওয়া আমাদের তরুণরা অনেক মেধাবী। তরুণদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিয়ে নিজেদের কর্মদক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল সেন্টারের এত দ্রুত বিকাশ ও এর মাধ্যমে সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রমাণ করে আমাদের তরুণরা মেধাবী। উন্নত দেশ গঠনে তরুণদের ভূমিকার প্রশংসা করে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমাদের মনে রাখতে হবে আমরা পারি, আমরা পারব। তোমরাই পারবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে অনেক এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’। প্রধানমন্ত্রী জানান, আউট সোর্সিংয়ের জন্য সরকার প্রশিক্ষণ দেবে। তার দাবি, এখন ঘরে বসে শুধু দেশেই নয়, বিদেশ থেকেও অর্থ উপার্জন করা যায়। এজন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিতে হবে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে বসে বিদেশের কাজ করে যাতে অর্থ উপার্জন করা যায় সে প্রশিক্ষণও আমরা দেব।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সরকার পরিচালনা সহজ হয়েছে উল্লেখ করে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গোটা পৃথিবীটা আপনাদের হাতের মুঠোয়। তিনি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যুর হিসাব রাখতে বলেন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের কখনও কখনও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরিয়ে দেন। উদ্যোক্তাদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করেন। তিনি বলেন, কোনো কিছু যখন ভালোভাবে চলে তখন অনেকে আসে সেখানে তাদের মামা, শালা, ভাই বা আত্মীয়দের বসানোর জন্য। আমি সতর্ক করে দিতে চাই, কেউ যেন শিং দিয়ে গুঁতোগুঁতি করে ঢোকার চেষ্টা না করে। প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এই বলে যে, এ উদ্যোক্তাদের কেউ সরাতে পারবে না। পারলে কেউ আলাদা করে এটা করুক। যারাই ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা তারাই থাকবে।
অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে ইন্টারনেটের গতি কম জানানো হলে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, সে জন্য ইন্টারনেটের এখনকার স্পিড সময়োপযোগী নয়। এর গতি আরও বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাইস্পিডের ইন্টারনেট চালুর জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা নতুন করে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আরেকটা পদক্ষেপ হচ্ছে নিজেরাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করব। এটা একনেকে পাস হয়েছে। ইন্টারনেটের গতি বাড়লে প্রযুক্তির আরও বিকাশ হবে, আরও সেবা বাড়বে। অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ জয়ও ইন্টারনেটের গতির বিষয়ে কথা বলেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের আগামীতে এলজিইডির বেশকিছু কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। জন্ম নিবন্ধন উদ্যোক্তারাই করবেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ডিজিটাল যুগ শুরু হয় মন্তব্য করে আশরাফ বলেন, তার আগে আমি লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পর ভালোভাবে এসেছি সে খবর স্ত্রীকে জানানোর জন্য লন্ডনে একটা ফোন করতে টিএন্ডটি অফিসে দু’দিন ঘুরতে হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে বাংলাদেশ সেই তিমিরেই থেকে যেত।
রংপুরের উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন ইন্টারনেটের ধীরগতি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের বাদ দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে এর প্রতিকার চান। রাঙ্গামাটির বিকাশ চাকমা বলেন, তিনি এ সেন্টারের মাধ্যমে এখন পরিবার ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারছেন।